আজকে আমরা আলোচনা করবো সকল গণিতবিদ,প্রকৃতিবিদদের সবচেয়ে পছন্দের গাণিতিক অনুপাত নিয়ে। যার মান 1.61803398875…। একে সোনালি অনুপাত (Golden ratio) বা স্বর্গীয় অনুপাত–ও বলা হয়। এটি একটি অমূলদ সংখ্যা। একে φ বা ‘ফাই‘(Phi) দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
সোনালি অনুপাত,নাম শুনেই বুঝা যাচ্ছে এ যেন সোনার মতোই এক দামী রত্ন! কিন্তু প্রকৃত অর্থে তা সোনা চেয়েও অনেক অনেক গুণ বেশি মূল্যবান । কেন এত মূল্যবান তা আমরা একটু পরেই জানতে পারবো।
এই মহাবিশ্বের বিশাল বিশাল গ্যালিক্সি থেকে শুরু করে আমাদের শরীরের অভ্যন্তরের ক্ষুদ্র ডিএনএ (DNA) পর্যন্ত এই অনুপাত অনুসরণ করে থাকে। আমরা যদি একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করি তবে দেখতে পাবো মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ,অন্যান্য সকল জীব,পদার্থবিজ্ঞান ,রসায়ন,আমাদের সম্পূর্ণ সৌরজগত,আমাদের গ্যালাক্সি এই সবকিছুর মধ্যে লুকিয়ে আছে সোনালি অনুপাত!
সোনালি অনুপাতের সাথে ফিবোনাচ্চি সিরিজের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ফিবোনাচ্চি সিরিজের সাথে আমরা সবাই কম–বেশি পরিচিত। এই শ্রেণীর যেকোন সংখ্যা তার পূর্ববর্তী দুটি সংখ্যার যোগফলের সমান হয়। যেমনঃ ০,1,1,2,3,5,8,13,21,34,55,89,144 0+1= 1,
1+1=2, 1+2=3, 2+3=5, 3+5=8
ফিবোনাচ্চি সিরিজ আবিষ্কার করেছিলেন ত্রয়োদশ শতাব্দীর বিখ্যাত গণিতবিদ Leonardo Da Pisa। তিনি বলেছিলেন, “প্রকৃতির মূল রহস্য এ রাশিমালাতে আছে“। এ রাশিমালা বলতে ফিবোনাচ্চি রাশিমালা। যদি এই সিরিজের একটি পদকে এর আগের পদ দ্বারা ভাগ করা হয়,তবে পাওয়া যায় ফাই (φ) এর মান। তালিকার প্রথম কিছু পদের ক্ষেত্রে মান ভিন্ন হলেও ৩৯ তম পদে গিয়ে তা ’ধ্রব’ হয়ে যাবে। 1/1 = 1, 2/1 = 2, 3/2 = 1·5, 5/3
= 1·666…, 8/5 = 1·6, 13/8 = 1·625, 21/13 = 1·61538…
এখানে দেখা যাচ্ছে,প্রথম ৩টি পদ বাদে অন্যগুলোর মান সোনালি অনুপাতের অনেকটা কাছাকাছি।
এবার ফিবোনাচ্চি সিরিজের সাথে সোনালি অনুপাতের জ্যামিতিক সম্পর্কে আসি। প্রথমে ফিবোনাচ্চি সিরিজের রাশিগুলো দিয়ে একটি চিত্র অঙ্কন করি। চিত্রে রাশিগুলোকে আলাদা আলাদা বর্গক্ষেত্র হিসেব করে ধারাবাহিকভাবে একটার পাশে অন্যটা বা প্রয়োজনে ডানে–বামে বসায়। বর্গক্ষেত্রগুলো প্রথমে ১ বর্গএকক, আবার ১ বর্গএকক , তারপর ২ বর্গএকক , তারপর ৩ , তারপর ৫,তারপর ৮,তারপর ১৩,তারপর ক্রমান্বয়ে ২১,৩৪ বর্গএকক । আমরা যখন ধারাবাহিকভাবে এটি আঁকতে থাকবো দেখা যাবে এটি একটি আয়তক্ষেত্র গঠন করবে। এই আয়তক্ষেতকে বলা হয় Golden Rectangle । এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিবারই আয়তের দৈর্ঘ্য : প্রস্থ = 1.6180…= Golden Ratio হবে। এবার আমরা আয়তের কর্ণগুলোকে একের পর এক যুক্ত করি তাহলে এখানে একটা spiral তৈরি হবে । একে বলা Golden Spiral ।
এই চিত্রটি আসলে কি জিনিস একটু পরে বুঝতে পারবেন।
* মানবদেহে Phi :
মানবদেহে Phi,এটাও কি সম্ভব? আচ্ছা এবার নিচে একটু লক্ষ্য করুন।
1.
মানবদেহের সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য : নাভির নিচ থেকে বাকি অংশের দৈর্ঘ্য = 1.6180.. ;
2. কাঁধ থেকে হাটু : হাটু থেকে পায়ের আঙ্গুলের মাথা পর্যন্ত = 1.6180… ;
3. মানুষের বাহু (বাইসেপ্স) : হাত = 1.6180..;
4. মানুষের মুখমণ্ডলের দৈর্ঘ্য : প্রস্থ= 1.6180… ; উল্লেখ্য, সকলের ক্ষেত্রে মুখের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ সমান হয় না। তাই এই মান কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। তবে আপনার মুখের অনুপাত Phi –এর মানের যত কাছে থাকবে আপনি তত বেশি সুন্দর হবেন।
5.
মানুষের আঙ্গুলের অগ্রভাগ থেকে কনুই এর দৈর্ঘ্য : কবজি থেকে কনুই এর দৈর্ঘ্যে= 1.6180… ;
6. ঠোঁটের দৈর্ঘ্য ও নাকের প্রস্থের অনুপাত =1.6180….;
7.
চোখের ২ প্রান্তের দূরত্ব : চুল থেকে চোখের মনির দূরত্ব = 1.6180… ।
ঠিক একইভাবে মানবদেহের সকল জায়গায় আমরা সোনালি অনুপাতের উপস্থিতি লক্ষ্য করতে পায়। মানবদেহে প্রায় ৩ শতাধিক Golden Ratio (Phi) খুঁজে পাওয়া যায় ।
*গ্যালাক্সিতে Phi:
নিচের চিত্রগুলোতে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির উপর Golden Spiral বসানো সম্ভব হয়েছে।
শুধু আমাদের গ্যালাক্সি নয়। সকল প্রকার কুন্ডলিত গ্যালাক্সি (spiral galaxies) গুলো Golden Spiral চিত্র অনুসরণ করে।
* সৌরজগতে Phi :
প্রায় সকল গ্রহই সূর্যকে কেন্দ্র করে একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরে। এই ঘূর্ণন পথেও Phi লক্ষ্য করা যায়। গ্রহগুলো পৃথিবীর আবর্তনকালের সাথে Phi এর সুচক আকারে ভিন্ন ভিন্ন হয় ।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে সোনালি অনুপাত 1:1.6180 = ০.৬১৮১… । ০.৬১৮১.. কেও গোল্ডেন রেসিও বলা হয়। কিন্তু একে ছোট হাতের ফাই ( φ ) দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
* ফুলের মধ্যে Phi:
সব ধরনের ফুলের পাপড়ি সংখ্যা সবসময় ফিবোনাচ্চি সংখ্যার কোনো একটা সংখ্যার হবে। আবার ফুলের অভ্যন্তরে প্রতি স্তরের রেণুর পরবর্তী স্তরের অনুপাত=1.6180..।
একটি মৌচাকে পুরুষ এবং মহিলা মৌমাছির সংখ্যার অনুপাত = 1.6180। ফুলের মধ্যভাগও (চিত্রের মতো ) ফিবোনাচ্চি সিরিজ মেনে চলে।
হারিকেনের সময় নিখুত Golden Spiral তৈরি হয়। হারিকেনের সময় আমরা যদি মহাকাশ থেকে পৃথিবীর বায়ুমন্ডল লক্ষ্য করি তবে খুব সহজেই তা বোঝা যায়।
* শামুক জাতীয় প্রাণিতে Phi :
শামুকের দেহ নরম হলেও শক্ত খোলস দ্বারা আবৃত থাকে। এই খোলসে আমরা Golden Spiral দেখতে পাই। এছাড়াও এর অভ্যন্তরেও Phi সৃষ্টি হয়।
মুরগির ডিমেও নিখুত Golden Spiral উৎপন্ন হয়।
* গাছ বৃদ্ধিতে Phi:
একটি সাধারণ গাছ বৃদ্ধি পাওয়ার ক্ষেত্রে সবসময় ফিবোনাচ্চি সিরিজ মেনে চলে। ঠিক যেমন প্রথমে 0+1= 1 টি ডাল। 1+1=2 টি ডাল। 1+2=3 টি ডাল। 2+3=5 টি ডাল। 3+5=8 টি ডাল। যত বড় হবে যথাক্রমেই ফিবোনাচ্চি সিরিজ অনুযায়ী যেতে থাকবে।
আমাদের DNA –র আমরা যদি Major Groove ও Minor Groove
এর অনুপাত করি তবে সেটাও হবে Phi
এছাড়াও অনেক অনেক অসংখ্য বস্তু Phi-কে অনুসরণ করে। এগুলো হয়তো বলে কখনোই শেষ করা সম্ভব নয়।
Phi এর সৌন্দর্য
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি–র শিল্পকর্মে Phi :
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি সর্বপ্রথম সোনালি অনুপাতের নাম দিয়েছিলেন ‘The Divine Proportion’ বা ‘স্বর্গীয় অনুপাত’ । এই নাম দেওয়ার প্রধান কারণ তিনিই প্রথম মানবদেহে Phi এর উপস্থিতি লক্ষ করেন। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে সোনালি অনুপাতের মাস্টার বলা হয়। তিনি এইসব কিছু প্রকাশ করতেন তার শিল্পের মাধ্যমে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা Monalisa –র বিখ্যাত ছবিটি আমরা সবাই চিনি। তিনি এই ছবিতে ব্যবহার করেছেন Phi ।
শুধুমাত্র Monalisa-র ছবিতে নয়। তিনি Mary Magdalene, The last
Supper সহ আরও অনেক শিল্পে তার স্বর্গীয় অনুপাত ব্যবহার করেছেন।
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ Phi এর গুরুত্ব এবং সৌন্দর্য সম্পর্কে জানতে পারে। Phi যেকোনো বস্তুকে সুন্দর আকৃতি দেয়। তাই মিসরের পিরামিডে , আগ্রার তাজমহলে , ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ারে , পারথেননে , ইউনাইটেড নেশন বিল্ডিং সহ অসংখ্য বিখ্যাত বিখ্যাত স্থাপত্যে Phi ব্যবহার করা হয়েছে।
বর্তমানেও ব্যাপকভাবে Phi ব্যবহার করা হয়। যেকোনো প্রকার লগো,ফোন,ওয়েবসাইট ইত্যাদি তৈরিতে Phi ব্যবহার করা হয়। Apple,Google, Adidas, Honda, Toyota,
Mercedes-Benz, CocaCola, Pepsi, National Geography ইত্যাদির মতো বড় বড় বিখ্যাত কম্পানিগুলোর লগোতে সোনালি অনুপাত ব্যবহার করছে।
এখন মূল কথা হচ্ছে, মানুষ তার ইচ্ছা মতো এমন লগো বানাতেই পারে। কিন্তু আমাদের মহাবিশ্ব তো কোনো মানুষ সৃষ্টি করে নাই । তাহলে এত নিখুতভাবে সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য Phi এর এরূপ ব্যবহার কিভাবে সম্ভব?
“তাহলে সৃষ্টিকর্তা কি একজন গণিতবিদ?” যে সবকিছৃুকে সুন্দর ও শৃঙ্খলার মধ্যে রাখতে চান? প্রশ্নগুলো শুধু আমার আপনার নয় বড় বড় যত বিজ্ঞানীসহ গণিতবিদরা আছেন সবারই! কিন্তু এই রহস্যময় প্রশ্ন এখনও রহস্য হিসেবেই রয়ে গেছে।
ওহহ ভালো কথা Mario Livio এর একটি বই আছে “Is God a mathematician?” পড়ে দেখতে পারেন। ভালো লাগবে আশা করি।
তথ্যসূত্রঃ
https://en.wikipedia.org/wiki/Golden_ratio
https://en.wikipedia.org/wiki/Fibonacci_number
https://io9.gizmodo.com/5985588/15-uncanny-examples-of-the-golden-ratio-in-nature
http://www.sacred-geometry.es/?q=en/content/phi-human-body
https://www.canva.com/learn/what-is-the-golden-ratio/
http://www.maths.surrey.ac.uk/hosted-sites/R.Knott/Fibonacci/fibnat.html
That is too much informative. All info was arranged sequentially and in a better way. Keep continue your progress to make it more better and efficient. Try to make it rich in more information (such as- the first user of Phi, the time when Phi was firstly used, by whom the Phi is invented, daily using of Phi, Phi in mathematical uses). Though, the present information are also not less at all. Those helped me a lot. Thank you.